বাবাকে হারিয়েছি ৯ বছর’- বাবাকে নিয়ে সন্তানের আবেগঘন লিখা - বার্তা প্রকাশ

বাবাকে হারিয়েছি ৯ বছর’- বাবাকে নিয়ে সন্তানের আবেগঘন লিখা

বাবাকে হারিয়েছি ৯ বছর’- বাবাকে নিয়ে সন্তানের আবেগঘন লিখা

মাসুম বিল্লাহ : সেদিন ছিল সোমবার।  ভোরে ঘুম ভাঙে মা ও ছোট বোন ফরিদার চিৎকারে। উঠে দেখি আব্বার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা তখনো জানিনা উনি নাই। ততক্ষণে আশপাশের লোকজন চলে এসেছে। বাড়িতে লোকজনের ভিড় বাড়ছে। আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ হাবিব ইসমাঈল ভূইয়া খবরটি পেয়েই ফজরের সময় ছুটে আসেন। আব্বাকে পরীক্ষা করে বলেন, নাই।

তখন থেকেই বোঝা গেল আব্বা আর নাই। এর আগে আশে—পাশের সবাই বললেও আমি বিশ্বাস করেনি। কারণ এই রকম অসুস্থ প্রায় হতেন। আমি মনে করেছিলাম হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবেন। খবরটি প্রচার হতে না হতেই আশপাশের লোকজন বাড়িতে আসতে শুরু করলো। আত্মীয়স্বজন, গণমাধ্যমকর্মী ও রাজনীতিবিদরাও আসতে থাকেন। মানুষ আসে আর কান্নাকাটি বাড়ে।

বাদ আছর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আড়াইহাজার ও নরসিংদী অঞ্চলের কিংবদন্তিতূল্য সাংবাদিক কাজী মোদাচ্ছের হোসেন সুলতানকে। কড়ইতলা মাদ্রসা প্রাঙ্গনে নামাজে জানাযায় হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লীগণ অংশ নিয়ে ছিলেন। নামাজে জানাযায় ইমামতি করেছি আমি নিজে।

২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে ভোরে আব্বা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাজারো মানুষের ভিড়ে সেদিন শোক ভুলে আব্বার নামাজে জানাযা ও দাফন কাফন নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কত দূর দূর থেকে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, চাকুরীজীবী, শিক্ষক—এমনকি প্রশাসনের লোকজন পর্যন্ত কড়ইতলায় আমাদের বাড়িতে ভিড় করেন। সকলকে হয়তো ঠিকমত বসতে দিতেও পারিনি। তবুও আগত লোকজন, আমাদের আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্খি—সকলেই সান্তনা দিয়েছেন। আব্বার কথা বলেছেন।

   সেদিনই বুঝেছি আমার আব্বা কেমন মানুষ ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি মানুষের কল্যাণে কিকি করে গেছেন। কিভাবে অসহায়—আর্তপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাড়াতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন একটি মহীরুহ। তার ছিল প্রচন্ড সাহস। দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা লিখতে কোন ভয় পেতেন না। এই জন্য বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেস্টা করা হয়েছিল।

বাচিঁয়ে দিয়েছেন আল্লাহ পাক। আব্বার গল্প আমি আমার মা , বড়বোন সাহিদা, ফুফাত ভাই আশরাফ আলী, মাওলানা এমদাদ উল্লাহ. কুতুব উদ্দিনের কাছ থেকে বেশি শুনেছি। এই সকল ঘটনা আমার জন্ম ও বড় হওয়ায় আগে। আমি বড় হওয়ার পর নিজের চোখে অনেক দেখেছি। শত্রুরা কিভাবে হায়েনার মতো তাকে শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। মানষিক যন্ত্রনা দিতো প্রতি নিয়ত।

তবুও তিনি হক কথা লিখতে পিছপা হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা থাকাকালিন সময়ে ততকালিন এমপি এমদাদুল হকের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করার কারণে আমার বাবার সকল চাকুরী কেড়ে নেয়। সেই সাথে আমার চাচার মাওলানা মোজাম্মেল হকের সকল চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেন। এই সকল নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কেটেছে আমার বাবার সাড়া জীবন। তারপরও ওনার ছেলে হিসেবে আমি গর্বিত।

এই বাবার একটু আগের কথা বলি, আব্বার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়েছিল দৈনিক আজাদ থেকে। পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। তাত প্রধান নরসিংদী ও আড়াইহাজার অঞ্চলের মানুষের সুখ—দুঃখ ও এই জনপদের খবরা—খবর পরিবেশন করতেন নিয়মিত। প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবনে বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছিলেন।

মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা এবং মহান আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে প্রাণে বেচে যান। ডাকাত প্রবণ এই অঞ্চলে সাংবাদিক কাজী মোদাচ্ছের হোসেন সুলতানের নাম শুনলে বাঘে—মহিষে একঘাটে জল খেত বলে জনশ্রম্নতি আছে। আড়াইহাজারের সাংবাদিকদের আগে কেউ তেমন একটা চিনতোনা। আমাকেও চিনার কথা না। যেখানেই যেতাম সবাই আমার আব্বার নাম বলতো। আড়াইহাজার ও আশপাশের বৃহৎ অঞ্চলে সাংবাদিক বলতে একজনকেই মানুষ চিনতো। তিনি হলেন ‘ইত্তেফাকের কাজী সুলতান’।

আব্বার নামেই আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে এই অঞ্চলে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। আব্বার মৃত্যুর খবরে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার এত মানুষজন আমাদের বাড়িতে আসবে ভাবতেও পারিনি। কত সিনিয়র সাংবাদিক এসেছিলেন। আমিতো অনেককে চিনতেও পারিনি। পরে জেনেছি। সেদিন চেনার মত মনমানসিকতাও ছিলনা। কত পুরনো রাজনীতিবিদ এসে অঝোর ধারায় কেদেছেন আব্বার কথা স্মরণ করে।

আমার চোখের পানি সেদিন কেনো জানি থেমে গিয়েছিল। সবার সাথে আমি কথা বলেছি। আব্বার দাফন—কাফনের আয়োজনের তদারকি করছিলাম। কাঁদবো কখন। তৎকালিণ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মরহুম বদরুজ্জামান খান খসরু জানাজায় গিয়ে কথা বলতে গিয়েও কেেঁদ ফেলেন। বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ ও তার স্ত্রীকে নিয়ে অসুস্থ হওয়ার পর ঢাকার শমরিতা হাসতালে দেখতে যান।

হাসপাতাল থেকে এসে বার বার মুঠাফোনে আমার কাছ থেকে খবর নিতেন। আব্বার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে হয়তো পারিনি। তবে তার নীতি আদর্শ মেনেই জীবনের পথ চলছি। আব্বা মৃত্যুর আগেই আমাকে বড় উপহার দিয়ে গেছেন ‘সাপ্তাহিক আমাদের আড়াইহাজার’ পত্রিকাটির ডিক্লারেশন নিয়ে। তার দেখানো ও শেখানো পথেই পত্রিকাটি আমি প্রকাশ করে যাচ্ছি। আজকে আব্বা আমাদের মাঝে নেই।

কিন্তু তার দোয়া ও ভালোবাসার ছায়া আছে আমাদের মাথার উপর। দেখতে দেখতে ৯ বছর শেষে ১০ বছর হয়ে গেলে আব্বার মৃত্যু। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা প্রতিবছর আড়াইহাজার থানা প্রেসক্লাবের উদ্যোগেও তাকে স্মরণ করি।

কাজী মোদাচ্ছের হোসেন সুলতানকে আজো এই জনপদের সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ হিসেবেই শ্রদ্ধাভরা চিত্তে স্মরণ করে থাকেন। আমরা তার নীতি ও আদর্শের পথ ধরেই সামনে এগোতে চাই। সবশেষে মহান আল্লাহপাক তাকে জান্নাতবাসী করুক এই কামনা করি। আমিন।

বাবাকে হারিয়েছি ৯ বছর’- বাবাকে নিয়ে সন্তানের আবেগঘন লিখা
বাবাকে হারিয়েছি ৯ বছর’- বাবাকে নিয়ে সন্তানের আবেগঘন লিখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *