বারদীতে ঢাক বাদক শত পরিবারের মানবেতর জীবন-যাপন,প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা।
একজনের গলায় ঢোল,আরেকজনের কাঁধে ঢাক আর অপরজনের হাতে ঝুমুর। তিনটি বাদ্যযন্ত্রই বেজে চলছে এক সঙ্গে। বাজনার তালে তালে তারা তিনজন নাচছেন। সেই তালে কিছুটা মেতে উঠেছেন চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীরাও।
হেলে-দুলে,নেচে-গেয়ে,তারাও বিষয়টা উপভোগ করছেন। এমনই অদ্ভুত সূরের মূর্চ্ছনার বিভোর সবাই। কিন্তু অলিখিত এক উদ্ভট নির্দেশের কারণে তা চীরতরে থেমে গেছে,হয়েছে জীবনের ছন্দ পতন। সোনারগাঁয়ের এই শিল্পের শিল্পীরা এখন কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

জীবিকার তাগিদে বংশ পরম্পনায় শত বছর আগে থেকেই তারা ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে যেতেন,এতে তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো। কিন্তু গত এক যুগ ধরে শব্দ দূষন এর দোহাই দিয়ে বারদী আশ্রমের আহ্বায়ক অশোক মাধব রায় ও তার কমিটির লোকেরা তা বন্ধ করে দিয়েছেন। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়,নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত সোনারগাঁ উপজেলার বারদী শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম,এখানে শত বছর ধরে বারদী রিবর গ্রামের মুনি ঋষি পাড়ার লোকজন আশ্রমে ঢাক বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন,কিন্তু আশ্রম কমিটির স্বেচ্ছাচারি সিদ্ধান্তের কারণে ঢাকের শব্দ থেমে গেছে এখন।
রিবর মুনি পাড়ার হরিশচন্দ্র মনি,নিখিল মনি,রাজকুমার মনি,লোকনাথ মনি,সঞ্জীবন মনি,নিখিল মনি (ছোট) সহ আরও অনেকের পরিবারই এখানে ঢাক বাজনা শিল্প না থাকার কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একব্যক্তি বলেন আমরা আশ্রমে দীর্ঘদিন যাবত বাজনা বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম,কিন্তু আশ্রমের আহ্বায়ক অশোক মাধব রায়ের কারণে আমরা মন্দিরে বাজনা বাজাতে পারিনা,আমাদের কি অপরাধ?আমরা এখন আমাদের পরিবার নিয়ে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছি।
জানা গেছে একযুগ আগেও দেখা যেতো বারদী রিবর গ্রামের মুনি ঋষি পাড়ার লোকজন অর্ধশতাধিক পরিবার ঢাক-ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু বারদী আশ্রম কমিটির অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় বারদী রিবর গ্রামের মুনি ঋষি পাড়ার লোকজনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তারা অনাহারে অর্ধাহারে দিন পার করছেন।
বারদী বাজারের এক ব্যবসায়ী, বলেন ওনাদেরকে তো আশ্রমে বাজাতে দেনই না,বারদীর হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন বিবাহ বা অন্নপ্রাশনের সময়ও বাজনা বাজাতে দেন না আশ্রম কমিটি।

কিন্তু তারা শব্দ দূষণের কারণ দেখিয়ে বারদী রিবর গ্রামের মুনি ঋষি পাড়ার লোকদের কাজ না দিয়ে বাহির থেকে ঠিকই বাদ্যকরদের নিয়ে আসেন,এ যেন এক হঠকারী রাজার রাজ্য। এ নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ বিরাজ করছে। বারদীতে অসন্তুষ্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই অবৈধ আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। বারদীর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মনে করেন আশ্রম কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যদি বারদীর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় থেকে হতেন তাহলে কখনো হঠকারী ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তাই অবিলম্বে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের মধ্য থেকে আশ্রম কমিটির জন্য সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক নিয়োগ এর মাধ্যমে দ্রুত বর্তমান অবৈধ আহ্বায়ক কমিটির অপসারণ চান তারা।
দুর্গাপূজার ছুটিতে যখন মানুষ কর্মস্থল থেকে ঘরে ফেরেন,তখনই ঢাক বাজানোর জন্য ঘর ছাড়তে হয় ঢাকিদের। বায়নার দিন থেকে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন মন্ডপে ঢাক বাজান ঢাকিরা। সারা বছর ছোটখাটো পূজা ও বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢাক বাজালেও বড় রোজগারটুকু এই দুর্গোৎসবের সময়ই হয়। আর সেখানেই অসৎ উদ্দেশ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন অশোক মাধব রায় ও তার কমিটি। আক্ষেপ নিয়ে তারা বলেন,এমনি আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম আসার কারণে ঢাকিদের আগের মতো কদর নেই।
শুধু হিন্দু ধর্মের পূজা,বিয়ে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই ঢাক-ঢোল বাজানো হয়। দিন দিন ঢাকের বাজনার কদর কমে যাচ্ছে। এখন কেবল পূজার অনুষঙ্গ হিসেবে ঢাক টিকে রয়েছে। আর আমাদের তো কেউ শিল্পী বলে মনেই করে না। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিদিন কাজ না থাকায় পেটের দায়ে অন্য কাজের চেষ্টা করতে হয় সারা বছর। কাজ পাইনা,পারিও না।

ছোট বেলা থেকেই ঢাক-ঢোল নিয়ে আছি। অন্য কোনো কাজ শিখিনি। ঢাক বাজলেই আমরা বাঁচি। যুগের পর যুগ ধরে দুর্গাপূজায় ঢাক বাজাই। আমাদের ঢাকের বাজনায় সবাই আনন্দ মেতে ওঠেন। কিন্তু আমাদের কথা ভাবে কে? তিনি আরো বলেন,আমরা ঢাকের বাজনার প্রসার চাই। উঠে যাক বারদী আশ্রম কমিটির অলিখিত নিষেধাজ্ঞা,এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই সরকারে পৃষ্ঠপোষকতা।